https://www.rbnews24.com/news/
দেশের দাবার বর্তমান অবস্থা
অফিসে প্রোজেক্টের মাঝখানে হঠাৎ করে ১০ দিনের একটা ফাঁক পেয়ে বাংলাদেশে ঘুরে আসলাম গত মাসে। দীর্ঘদিন দেশে দাবাখেলেছি আমেরিকা আসার আগে। তাই দেশে যাবার কথা মনে হলেই বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কথা যেমন মনে পরে, তেমনি মনে পরে আমার দাবার সহ-খেলোয়াড়দের কথা। ৯০এর দশকের মাঝামাঝি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষ করে বিকেলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দাবা ফেডারেশনে চলে যেতাম খেলতে। সারা সন্ধ্যা এমনকি রাত দশটা পর্যন্ত খেলে উল্টো দিকের চায়ের দোকানে বসে পুরি ভাগ করে খেতে খেতে বোর্ড গুটির অভাবে মুখে মুখে খেলে ফেলতাম দুই একটা গেম। যেই বয়সে বন্ধুরা মেয়েদের সাথে ডেটিং করে বেড়াতো, সেই বয়সে আমরা ৬৪ ঘরের বোর্ডে মুখ বুজে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চেয়ে রাইতাম ববি ফিশার অথবা কাপাব্লাঙ্কার একটা তাক লাগানো চাল দেখে!
আমি দেশে রওনা হবার দুই দিন আগে গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাবের আমির আলী রানা ভাই ফেসবুকে নক করলেন - "শুনলাম ঢাকা আসছেন? আপনি তো আসলে একটা টুর্নামেন্ট দেন, এবার করবেন না?" টুর্নামেন্ট স্পনসর করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময়ের অভাবে ঢাকায় যোগাযোগ করে রাখতে পারিনি আগে। তাই রানা ভাই যখন বললেন উনি আয়োজনের সব ব্যবস্থা করবেন, আমার শুধু একটা স্পন্সরের নাম আর টাকাটা জোগাড় করতে হবে, আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। আমার দীর্ঘ দিনের দাবা বন্ধু শাকিল আর পরাগের সাথেও কথা বলে নিলাম।রানা ভাই ম্যাজিসিয়ানের মতো অল্প সময়ে সবআয়োজন করে ফেললেন। দাবা ফেডারেশনে খেলা হবে দুই দিন সকালে। চিফ গেস্ট গ্রান্ড মাস্টার জিয়াউর রহমান এবং আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ। আমার ভাই রাশেদুজ্জামানের ব্র্যান্ড প্রমোশন কোম্পানি রেকট্যাংগল বিডি এর নাম অনুযায়ী এর নাম রাখা হলো রেকট্যাংগল রেপিড চেস টুর্নামেন্ট।
টুর্নামেন্টের উদ্বোধন হলো ৮ই মে দাবা ফেডারেশনে। ঐদিন চার রাউন্ড খেলা আর পরদিন ৩ রাউন্ড, সাথে আবার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। তাইবুর রহমান সুমন ভাই চ্যাম্পিয়ন হলেন আর জিয়া ভাই রানার আপ। কাকতালীয় ভাবে একই সময়ে শিপলু (ফিদে মাস্টার এবং আমার পুরোনো বন্ধু) অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছুদিনের জন্য ঢাকা এসেছে। ফেসবুকের কল্যানে ও জানতে পারলো আমি ঢাকায়। সেও আমাদের সাথে জয়েন করলো টুর্নামেন্ট এর দ্বিতীয় দিন।ফেডারেশনে পুরোনো অনেক খেলোয়াড়কে পেয়ে গেলাম। রানী আপা এই বয়সেও শিশুর মতো আগ্রহ নিয়ে গুটি চালছেন। শুধু তাই না উনি এবছরেও ন্যাশনাল ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন হয়ে আরেকটা রেকর্ড করলেন মাত্র কয়দিন আগে। জিয়া ভাই আগের মতোই খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশে আর বাইরে। জিয়া ভাই, সুমন ভাই, শিপলু, শাকিল আর পরাগ একটা গেমের পোস্ট মর্টেম করছে। আর ইন্টারন্যাশনাল আরবিটার হারুন ভাই আগের মতোই বলে উঠছেন, "শব্দ করা যাবে না, পাশের রুমে খেলা চলছে।"
তবে সবার কাছ থেকেই জানতে পারলাম দেশের দাবা অঙ্গন হুমড়ি খেয়ে পরে আছে। রানা ভাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু ফেডারেশনের আরো টুর্নামেন্ট আয়োজন করা দরকার। যথেষ্ট টুর্নামেন্ট না থাকায় ভালো খেলোয়াড় বেরিয়ে আসছে না। তরুণ খেলোয়াড়েরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে আর পুরোনো খেলোয়াড়েরা হতাশ। ফেডারেশন বছরে হাতে গোনা কয়টা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ, প্রিমিয়ার ডিভিশন লীগ টুর্নামেন্ট করেই খালাস। রাজিব-রাকিবের পর অনেকগুলো বছর আমরা কোনো গ্রান্ড মাস্টার পাই নি। দুই তরুণ আন্তর্জাতিক মাস্টার সাগর আর শাকিল চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু যদি বছরে ২টা গ্রান্ড মাস্টার টুর্নামেন্ট করা যেত তবে হয়তো অনেকের জন্যই কাজটা আর অসম্বভ হয়ে থাকতো না। কিশোর ফিদে মাস্টার ফাহাদ রহমান এর মাঝেই উঠে আসছে, কিন্তু তার প্রথমে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার টাইটেল জিততে হবে। ফিদে মাস্টার কায়েস ভাই কিছুদিন আগে চলে গেলেন কানাডা। আরো অনেক খেলোয়াড় বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন আগেই।
দেশে স্পনসর করার মতো বিত্তশালী লোকের অভাব নেই, কিন্তু তারা সবাই ক্রিকেটে টাকা দিচ্ছে, ব্র্যান্ড মার্কেটিং এ সুবিধা হয়। কিন্তু অন্য খেলা গুলো ও তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মাসে একটা দাবার রেটিং টুর্নামেন্ট করা যে অনেক খরচের ব্যাপার তাও তো না। খেলোয়াড়রা নিজস্ব খরচে যতটুকু সম্ভব করে যাচ্ছে। আমার এখানে আমেরিকার কথা বাদ ই দিলাম, পাশের দেশ ইন্ডিয়া তে কর্পোরেট স্পনসর আর সরকারের সহযোগিতায় অনেক অনেক ভালো খেলোয়াড় প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে। অথচ উপমহাদেশের প্রথম গ্রান্ড মাস্টার কিন্তু ভারতের প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ নয়, বরং আমাদের গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। খুব বেশি দাবাখেলোয়াড় বাংলাদেশে স্বচ্ছল বেবসা বাণিজ্য করছে এমন শুনি না।
যেই অল্প কয়েকজন আছেন, তা যথেষ্ট নয়। এইজন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকল প্রাক্তন দাবা খেলোয়াড় এবং দাবানুরাগীদের। সাথে দরকার কর্পোরেট এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। দূরে থেকে আমরা দুই বছরে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করে কিছু করতে পারব না। টুর্নামেন্ট হতে হবে নিয়মিত। আমি যেই সময়টায় ঢাকায় খেলতাম তখন অবস্থা অনেক ভালো ছিল এখনকার তুলনায়। মাঝের কিছু ফেডারেশন কমিটি দেশের দাবাকে জোর করে ধরে পেছনে নিয়ে গেছে।
কিন্তু হতাশ হয়ে বসে থেকে লাভ নেই। সামনের দিকে আমাদের চোখ তুলে তাকাতে হবে। ক্রিকেট আর ফুটবলের পর দাবাতেই আমরা তুলনামূলক ভাবেশক্তিশালী । পাঠক, আপনারা কি দাবাঙ্গনের উন্নয়নে কোনোভাবে অংশগ্রহন করতে পারেন?
আশিক উজ্জামান,
সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, রোকু ইনক., সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া